
বিশেষ প্রতিনিধি | আলমগীর হোসেন |
গাজীপুর জেলার কোনাবাড়ী ভান্ডারী গলির মানুষ আজ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে এক দেলোয়ার নামের রহস্যময় ব্যক্তিকে নিয়ে। কখনো নিজেকে ডাক্তার, কখনো সাংবাদিক, আবার কখনো গ্যাস কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তিনি বছরের পর বছর ধরে প্রতারণা চালিয়ে আসছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। তার ভুয়া প্রভাবের কারণে অসহায় মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে, অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপের দেখা মেলেনি।
দেলোয়ার প্রথমে “স্বপন মেডিকেল হল” নামে একটি ফার্মেসি খুলে ডাক্তার পরিচয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি রোগীও দেখতেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, ভুল ইনজেকশন দেওয়ার কারণে এক রোগীর মৃত্যু হলে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে আটক করলেও মার্কেট মালিক মো. জসিম ভান্ডারী ঘটনাটি ধামাচাপা দেন। এরপরও তার প্রতারণার পথ থেমে থাকেনি।
ডাক্তার পরিচয় ভেঙে পড়লে দেলোয়ার সাংবাদিক সেজে নতুন খেলা শুরু করেন। মোটা অংকের টাকা দিয়ে ৭১ বাংলা টিভির পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন এবং সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজি চালাতে থাকেন। হোটেল থেকে চাঁদা আদায়, সহকর্মী সাংবাদিক কাশেমকে বিতাড়িত করা—সবই ছিল তার নিয়মিত কাজ।
একজন সিনিয়র সাংবাদিক অভিযোগ করে বলেন—
> “দেলোয়ার সাংবাদিকতার নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করেছে। প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে কলঙ্কিত করেছে।”
কিছুদিনের মধ্যেই দেলোয়ার নিজেকে তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে নতুন কৌশলে প্রতারণা শুরু করেন। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৩০–৪০ হাজার টাকা দাবি করতেন। কামরাঙ্গাচলা এলাকায় একাধিক বাড়িতে এভাবে চাঁদা দাবি করলে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে ধরে ফেলেন। পরবর্তীতে বিএনপি নেতা রাজ্জাক চৌধুরীর হস্তক্ষেপে এবং সাংবাদিক আলমগীর হোসেন ও মেহেরাব হোসেনের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু সেখান থেকেও শিক্ষা নেননি দেলোয়ার।
দেলোয়ার সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ আশিকুর রহমান জিয়ার কাছ থেকেও মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ ওঠে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেলোয়ারের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী। ওষুধ কোম্পানির কাছে ঋণ পরিশোধ না করায় তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, যা বর্তমানে গাজীপুর আদালতে চলমান।
এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, ভান্ডারী গলিতে অন্তত ১৩–১৪টি বাড়ি থেকে মাসিক চাঁদা তুলতেন তিনি। এমনকি আলামিন নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে এককালীন ৪০ হাজার টাকা এবং পরবর্তীতে মাসিক ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেন।
দেলোয়ার নিজেকে কখনো পুলিশ আবার কখনো ডিবির সোর্স পরিচয় দিতেন। সামান্য বিবাদের কারণে তিনি হেলাল চাকরাদার নামের এক ব্যক্তিকে মিথ্যা মামলায় জেল খাটান। পরে হেলালের স্ত্রীর কাছ থেকে মাসে ৪ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করতেন তিনি। টাকা না দিলে অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদ করে দেওয়ার হুমকি দিতেন।
এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে—
“গ্যাসের অভিযান আসছে, টাকা না দিলে ঘরে অভিযান হবে”—এমন হুমকি দিয়ে দেলোয়ার মানুষকে ভয় দেখাতেন। যারা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানাতেন, তাদের বাড়ি গ্যাস কর্মকর্তাদের দেখিয়ে দিতেন তিনি।
একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী দেলোয়ারকে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সামনে ধরে চড়-থাপ্পড় মারে এবং বিচার দাবি করে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
মানুষের প্রশ্ন—কবে থামবে দেলোয়ারের প্রতারণা?
গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকার অন্তত পাঁচ লক্ষ মানুষ দেলোয়ারের প্রতারণা, ভুয়া পরিচয় ও চাঁদাবাজির কারণে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সাধারণ মানুষের বক্তব্য—
> “সাংবাদিকের কাজ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কিন্তু দেলোয়ার আমাদের বিপদে ফেলেছে। প্রশাসন কবে ব্যবস্থা নেবে?”
ভুয়া পরিচয়ের আড়ালে দেলোয়ার শুধু প্রতারণাই চালাচ্ছে না, বরং সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে কলঙ্কিত করছে। এলাকাবাসী এখন একটাই প্রশ্ন তুলছে—কবে এই ভুয়া দেলোয়ারের প্রতারণার ইতি ঘটবে?